পাপপুণ্য হৃদপিণ্ডে থাকে

Print Friendly, PDF & Email

প্রাচীনকালে মানুষের ধারণা ছিল যে, মন মানুষের হৃদয়ে থাকে। এই নিয়ে নানা কাব্য সঙ্গীত আজও আমরা শুনে থাকি। মূলত প্রেম ভালবাসা কিংবা দুঃখের অনুভূতি হলে মানুষের হৃদপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যেতো, এ থেকেই মানুষের ধারণা হতো যে, মন আসলে হৃদপিণ্ডের মধ্যে অবস্থিত। হৃদপিণ্ড মানুষের আবেগ অনুভূতি এবং চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু, প্রাচীন এই ধারণাকে বলা হয় কার্ডিওসেন্ট্রিজম। এই ধারণার প্রাচীন মিশরে শক্তিশালী হয়, এরপরে গ্রীক দার্শনিক যেমন অ্যারিস্টটল, ডায়োক্লিস এবং প্রাক্সগোরাস এর কস দ্বারাও এই ধারণাটি গৃহীত হয়েছিল [1]। অ্যারিস্টটল যেহেতু প্রাচীনকালের সবচাইতে প্রভাববিস্তারকারী দার্শনিক ছিলেন, তাই তার এই ধারণাই পরবর্তী যুগে সবচাইতে প্রভাবশালী ধারণা হিসেবে সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পায়। এই সময়ে লিখিত প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থেই এই বিষয়টিই তাই প্রাধান্য পায়, যেমন বাইবেলেও মন এবং হৃদপিণ্ডকে এক করে ভাবা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীগণ প্রমাণ করেছেন, মানুষের আবেগ অনুভূতি স্মৃতি চিন্তা সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্ক। হৃদপিণ্ডের কাজ শুধুমাত্র রক্ত সঞ্চালন ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনকি, হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনও বর্তমান যুগে সম্ভব হয়েছে। এমনকি শূকরের হৃদপিণ্ড মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়েছে [2]

কিন্তু ইসলাম ধর্মে বাইবেলের মতই হৃদপিণ্ডকে মন, আত্মা, পাপপুণ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কোরআনের বহু স্থানেই বলা হয়েছে, হৃদয়ের কথা। উপমা দেয়ার সময়ও বহু সংখ্যকবার বক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু একবারও মস্তিষ্কের সাথে মন বা চিন্তাভাবনা বা স্মৃতির কোন সম্পর্কের কথা ইঙ্গিত করা হয়নি। সহজেই বোঝা যায় যে, কোরআনের লেখক প্রাচীন মিশরীয় ধারণা এবং অ্যারিস্টটল দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন [3] [4] [5] [6]

জেনে রাখো, নিশ্চয়ই তারা নিজেদের বক্ষদেশ ঘুরিয়ে দেয় যেন আল্লাহর নিকট হতে লুকাতে পারে। শোন, তারা তখন কাপড়ে নিজেদেরকে আচ্ছাদিত করে, তিনি তখনও জানেন যা কিছু তারা চুপিসারে বলে আর প্রকাশ্যভাবে বলে। নিশ্চয় তিনি জানেন যা কিছু বক্ষ/অন্তর সমূহে নিহিত রয়েছে।
– কোরআন, সূরা হুদ, আয়াত ৫

তারা কি এই উদ্দেশ্যে দেশ ভ্রমণ করেনি, যাতে তারা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারে? বস্তুত: চক্ষু তো অন্ধ হয় না, বরং বক্ষস্থিত হৃদয়/অন্তরই অন্ধ হয়।
– কোরআন, সূরা হাজ্জ, আয়াত ৪৬

আর আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ। তাদের হৃদয়/অন্তর রয়েছে, তারা এর দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তারা এর দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তারা এর দ্বারা শোনে না। …
– কোরআন, সূরা আ’রাফ, আয়াত ১৭৯

অতঃপর আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করতে চান, তার বক্ষকে ইসলামের জন্যে উম্মুক্ত করে দেন এবং যাকে বিপথগামী করতে চান, তার বক্ষকে অত্যধিক সংকীর্ণ করে দেন-যেন সে সবেগে আকাশে আরোহণ করছে। এমনিভাবে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে না আল্লাহ তাদের উপর আযাব বর্ষন করেন।
– কোরআন, সূরা আন’আম, আয়াত ১২৫

একইসাথে, হাদিসেও একাধিকবার এই বিষয়টি উল্লেখ করে বোঝানো হয়েছে যে, মানুষের চিন্তাভাবনা, স্মৃতি, আবেগ অনুভূতি সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু আসলে বুকের ভেতরে থাকা হৃদপিণ্ড, যা বৈজ্ঞানিকভাবে মস্তবড় ভুল। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, ফেরেশতা জিব্রাইল শিশু বয়সে নবী মুহাম্মদের হৃদপিণ্ড পরিষ্কার করে পাপ মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ফেরেশতা জিব্রাইলের আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থাকলে তিনি নিশ্চয়ই হৃদপিণ্ড পরিষ্কার না করে মস্তিষ্কটি পরিষ্কার করতো [7] [8]

সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ১/ কিতাবুল ঈমান
পরিচ্ছদঃ ৭৩. রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মি’রাজ এবং নামায ফরয হওয়া
৩১০। শায়বান ইবনু ফাররুখ (রহঃ) … আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) এলেন, তখন তিনি শিশুদের সাথে খেলছিলেন। তিনি তাঁকে ধরে শোয়ালেন এবং বক্ষ বিদীর্ণ করে তাঁর হৎপিন্ডটি বের করে আনলেন। তারপর তিনি তাঁর বক্ষ থেকে একটি রক্তপিন্ড বের করলেন এবং বললেন এ অংশটি শয়তানের। এরপর হৎপিণ্ডটিকে একটি স্বর্ণের পাত্রে রেখে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করলেন এবং তার অংশগুলো জড়ো করে আবার তা যথাস্থানে পূনঃস্থাপন করলেন। তখন ঐ শিশুরা দৌড়ে তাঁর দুধমায়ের কাছে গেল এবং বলল, মুহাম্মাদ -কে হত্যা করা হয়েছে। কথাটি শুনে সবাই সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল তিনি ভয়ে বিবর্ণ হয়ে আছেন! আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বক্ষে সে সেলাই-এর চিহ্ন দেখেছি।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

লাহাব
লাহাব

কাছাকাছি বক্তব্য বর্ণিত আছে আর একটি সহিহ হাদিসে। কিন্তু এখানে পেট চিড়ে দুইটি কাল রঙের রক্তপিণ্ড বের করে ফেলা হয় বলে বর্ণিত হয়েছে [9]

সুনান আদ-দারেমী (হাদিসবিডি)
ভূমিকা
পরিচ্ছেদঃ ৩. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাথমিক অবস্থা কেমন ছিল?
১৩. উতবা ইবনু আব্দুস সুলামী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবী ছিলেন, তিনি তাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল: ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনার (জীবনের) প্রাথমিক অবস্থা কেমন ছিল? তিনি বললেন: ’বনী সা’দ ইবনু বাকর গোত্রে এক মহিলা ধাত্রী (দুধ মাতা-হালিমা) আমাকে প্রতিপালন করেছেন। (তাঁর নিকট থাকা অবস্থায় একদা) আমি ও তার (দুধ মাতার) ছেলে মেষ চরাতে গেলাম কিন্তু আমাদের সাথে কোন খাদ্য ও পানিয় নিলাম না। তাই আমি বললাম: হে আমার (দুধ) ভাই! যাও, আমাদের মায়ের নিকট থেকে কিছু খাবার নিয়ে এসো।’ ভাই চলে গেলে আমি মেষপালের নিকট থেকে গেলাম। তখন শকুনের মত সাদা রংয়ের দু’টি পাখি (সদৃশ ফেরেশতা) আমার নিকট উপস্থিত হল। তাদের একজন অপরজনকে বলল: ইনিই কি তিনি? অপরজন বলল: হাঁ। তারা দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে ধরে চিত করে শুইয়ে দিল। তারপর আমার পেট চিরে ফেলে আমার ’কলব’ বের করে সেটিও চিরে ফেলল। সেখান থেকে কালো রংয়ের দু’টি রক্তপিণ্ড বের করে ফেলল। এরপর তাদের একজন তার সাথীকে বলল: বরফের পানি নিয়ে আস। অতঃপর সে পানি দিয়ে আমার ভেতরটা ধুয়ে দিল। এরপর বলল: এবার তুষার (শীতল) পানি নিয়ে এসো। আর তা দ্বারা সে আমার কলবকে ধুয়ে দিল। তারপর বলল, ’সাকিনাহ’ (স্থিরতা/ মানসিক দৃঢ়তা) নিয়ে এসো।’ এরপর সে তা আমার কলবের ভিতরে ছড়িয়ে দিল। তারপর একজন অপরজনকে বলল: সমান করে সেলাই করে দাও, ফলে সে সমান করে সেলাই করে দিল। তারপর তার উপর নবুওয়াতের মোহর দিয়ে সিলগালা করে দিল। তারপর একজন অপরজনকে বলল: তাঁকে এক পাল্লায় রাখ এবং তাঁর উম্মাতের এক হাজার লোককে আরেক পাল্লায় রাখ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ফলে আমি যখন আমার উপরের দিকে উঠে যাওয়া পাল্লার হাজার লোকের দিকে তাকালাম, তখন আমার ভয় হচ্ছিল যে, তাদের কেউ আবার আমার উপরে পড়ে যায় কি-না।’ তারপর সে বলল: যদি তাঁর সকল উম্মতকেও তাঁর সাথে ওজন করা হয়, তবুও তাঁর পাল্লা ঝুঁকে যাবে।’ তারপর তারা দু’জন আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তখন আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর আমার (দুধ) মা’র নিকট এসে আমি যে ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম, তা সব খুলে বললাম। তিনি আশংকা করলেন যে, আমাকে নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই তিনি বললেন: আমি তোমার জন্য আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তারপর তিনি তার উষ্ট্রীতে সাওয়ার হলেন এবং আমাকেও তুলে নিয়ে আমার পিছনে বসে যাত্রা করলেন। এভাবে সোজা আমার মা’য়ের নিকট পোঁছে গেলাম। তারপর তিনি বললেন: আমি আমার আমানত ও যিম্মা আদায় করেছি।’ এবং আমাকে কেন্দ্র করে যা কিছু ঘটেছে তিনি তাকে সব খুলে বললেন। কিন্তু তিনি এতে ভয় পেলেন না। বরং তিনি বললেন: তার ভুমিষ্ঠ হওয়ার সময় আমি এমন একটি নূর দেখেছি, যাতে শামের (সিরিয়া অঞ্চল) রাজপ্রাসাদও আলোকিত হয়ে গিয়েছিল।”[1]
[1] তাহক্বীক্ব: এর সনদ যয়ীফ। অপর দু’টি সনদে আহমাদ, হাকিম, তাবারানী বর্ণনা করেছেন, যার সনদ সহীহ ।
তাখরীজ: আহমাদ, আল মুসনাদ ৪/১৮৪-১৮৫; হাকিম, আল মুসতাদরাক, নং ৪২৩০; তাবারানী, মু’জামুল কাবীর নং ৩২২।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

তথ্যসূত্র

  1. Cognitiveneuropsychology (2011-09-25). “Cognitive Neuropsychology 101: The History of Neuropsychology”Cognitive Neuropsychology 101. Retrieved 2019-07-02. []
  2. চিকিৎসা: প্রথমবারের মত এক আমেরিকান ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা হল শূকরের হৃদপিণ্ড []
  3. কোরআন, সূরা হুদ, আয়াত ৫ []
  4. কোরআন, সূরা হাজ্জ, আয়াত ৪৬[]
  5. কোরআন, সূরা আ’রাফ, আয়াত ১৭৯ []
  6. কোরআন, সূরা আন’আম, আয়াত ১২৫ []
  7. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বর- ৩১০ []
  8. সহিহ মুসলিম খণ্ড ১ পৃষ্ঠা ১৯৮, ১৯৯ []
  9. সুনান আদ-দারেমী (হাদিসবিডি), হাদিস নম্বরঃ ১৩ []
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন